ফসলের অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান বালাইনাশক। এটি ফসল উৎপাদন ও সুরক্ষার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি ফসলের পোকামাকড়, আগাছা, রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে। এসব বালাইয়ের উপদ্রবে ফসলের শতভাগ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এর সমস্যা, সম্ভাবনা ও আমাদের করণীয় নিয়ে কথা বলা দরকার।
প্রথমত, এ বালাইনাশকগুলো একসময় বিনামূল্যে দেয়া হতো। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যখন এগুলো আমদানি করতে হয়, তখন প্রশ্ন জাগে আমাদের দেশের কৃষিবিদ, কৃষিশিক্ষা, কৃষি গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এ বিষয়কে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে। গত বছর সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বালাইনাশক কৃষককে ক্রয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি আমাদের আমদানি করতে হয়েছে, যার প্রযুক্তি জ্ঞান আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যারা রয়েছেন, তারা এগুলো প্রতিনিয়ত ছাত্রদের অধ্যয়ন করাচ্ছেন। গবেষণায় এগুলোর সুযোগ আছে। এ বালাইনাশক একসময় বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে, সেই সময়ের কোম্পানিগুলোর ভূমিকার কারণে এগুলো হচ্ছে কিনা তা দেখার বিষয় রয়েছে। মাত্র পাঁচটি বহুজাতিক কোম্পানি আটটি প্যাটেন্ট পণ্য দিয়ে দেশের ৫৫ শতাংশ বাজার দখল করে রেখেছে। অথচ তাদের এতদিনে এখানে উৎপাদন করে রফতানি করার কথা। কিন্তু তারা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়ে রেখে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বানিয়ে নিয়ে আসছে। কী দামে আনছে বা কী দামে বিক্রি করছে এবং সরকারি একটি সংস্থা তাদের পার্টনার রয়ে গেছে, সেখানে কতটুকু মুনাফা দিচ্ছে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো কোথায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে—এ বিষয়গুলো নিয়ে কার কাছে গেলে সমাধান পাব সে বিষয়ে দু-একটি কথা বলা দরকার। যেমন আমাদের কাঁচামাল আমদানির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জিরো ট্যারিফ দিয়েছে। অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্টের ওপর জিরো ট্যারিফ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর সহায়ক উপাদান—জাইলিন ও পানি যেটি কিনা লাখ লাখ লিটার মাসে আমদানি করতে হচ্ছে। আমরা যারা উৎপাদন করি তাদের অন্যান্য উপাদান ৩৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আনতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন লাভজনক হচ্ছে না। আমদানিই নিরাপদ হচ্ছে। কারণ যারা বিনিয়োগ করেনি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেনি, যারা অবকাঠামো করেনি, মেশিন নেই, যাদের দক্ষ জনবল নেই, যার ল্যাবরেটরি নেই, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য অপরিহার্য থাকলেও সেটিও নেই—তারাই জিরো ট্যারিফের সুবিধা পাচ্ছে। আমরা যারা উৎপাদন করি, তাদের ৩৫ শতাংশ ডিউটি ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডিউটি ট্যাক্স জিরো হওয়া উচিত। এটি করা গেলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং কৃষক ৩০-৪০ শতাংশ কম দামে সেটি পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আমরা যারা উৎপাদন করি তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নিতে হয়। এটি খামার বাড়িতে জমা দেয়ার পর মন্ত্রণালয়ে যায়। এটির দীর্ঘসূত্রতা আছে এবং প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করতে হয়। প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন একটি অদ্ভুত বিষয়। আমার পণ্য আসেনি, আমার ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কী পরিদর্শন করবে? এক মাসে পাঁচটি চালান এলে পাঁচবার পরিদর্শনে যাওয়া হবে। এটি কিন্তু পোস্ট ইন্সপেকশন বা চট্টগ্রাম বন্দরেই অনায়াসে করা যায়। এ দীর্ঘসূত্রতার কারণে আমাদের অনেক জরিমানা দিতে হচ্ছে। কাগজ দেরিতে পাওয়ার কারণে মাল দেরিতে খালাস হচ্ছে। কৃষি সচিব সিঙ্গেল সোর্সের সঙ্গে আরেকটি সোর্স যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছেন। এতে আমদানিকারকদের সুবিধা হয়েছে।
উৎপাদনকারীরা যে কাঁচামাল নিয়ে আসে, সেই কাঁচামাল আমাদের এখানে তালিকাভুক্ত হয় না। কাঁচামাল উৎপাদনকারী একজন এবং তৈরি পণ্য বা ফিনিশড পণ্য উৎপাদন করে একজন। ফিনিশড প্রডাক্ট যিনি উৎপাদন করেন, তিনি অন্যের কাছ থেকে কাঁচামাল নিয়ে বাংলাদেশে তার কোম্পানির নাম তালিকাভুক্ত করেন। ফলে এ তালিকার মধ্যে কাঁচামাল উৎপাদনের কোনো তালিকা নেই। ফলে আমরা এর সুবিধাভোগী হচ্ছি না। প্যাটেন্ট প্রডাক্টের ক্ষেত্রে আমাদের সংসদে আইন পাস হয়েছে, এলডিসির কারণে বাংলাদেশে প্যাটেন্ট প্রযোজ্য নয়। কিন্তু প্যাটেন্ট প্রডাক্টের লাইসেন্সের জন্য আমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। তারা কিন্তু লাইসেন্স দিতে পারেন। কোথা থেকে এবং কীভাবে পণ্য নিয়ে আসা হবে সেই বিষয়ে অনুমোদন দিতে পারে। যেহেতু এলডিসির সুবিধা আছে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো এ সুবিধা পাচ্ছে। এগ্রোকেমিক্যাল সমানভাবে সুবিধাভোগী হওয়ার কথা। কিন্তু আইন দ্বারা সংরক্ষিত করা আছে। কিন্তু আমরা যারা উৎপাদনকারী তারা এ সুবিধা পাচ্ছি না। কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কথা বলে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের থামিয়ে দেয়া হয়। দেশে ২২টি কোম্পানিকে উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ২২টি ল্যাবরেটরি স্থাপন হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তারা কাজ করতে পারে এবং নিবিড়ভাবে তদারকি করতে পারে। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালস ও এগ্রোকেমিক্যালসের নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটিই। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ন্ত্রণকে অনুসরণ করা হয়। আমরা ফার্মাসিউটিক্যালসে রফতানি করছি। কিন্তু এগ্রোকেমিক্যালসে রফতানি তো দূরের কথা, উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা এগোতে পারছি না। স্থানীয় বাজারে যারা তৈরি পণ্য নিয়ে আসছেন, যার কাছ থেকে তৈরি পণ্য নিয়ে এসেছেন তিনি সেই পণ্যের কাঁচামাল ক্রয় করছেন অন্য কোম্পানির কাছ থেকে। আমরা সেই কোম্পানির কাছ থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে এখানে যদি তৈরি করি, তাহলে আমরাই তো স্থানীয় কোম্পানির সোর্স হতে পারি। ১ হাজার ৩০০ কোম্পানিকে আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, যেখানে চীনের মতো ১৪০ কোটি মানুষের দেশে ১ হাজার ৭০০ ট্রেডিং কোম্পানি। এগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সরকারি উদ্যোগ জরুরি। বিনিয়োগকারীর পূর্বনিয়ত থাকে না। বিনিয়োগকারী শুধু দেখে কোথায় লাভজনক ও নিরাপদ। বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ করার দায়িত্ব সরকারের। তারাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাত চিহ্নিত করবে।
কৃষি শিল্প ছাড়া অর্থনৈতিক রূপান্তর সম্ভব নয়। কৃষিকে নিরাপদ ও লাভজনক করতে হলে একটি কৃষি কমিশন করা জরুরি। এগ্রোকেমিক্যাল শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আমদানির বিকল্প পণ্য এখানে তৈরি করে রফতানি করার জন্য এসব প্রস্তাব এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ে দেয়া আছে। মন্ত্রণালয় এসব বিষয় পুনর্বিবেচনা করে দেখবে এবং স্থানীয় উৎপাদনকে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ম্যানুফাকচারিংয়ের নেতারা ও শিল্পের যেসব প্রতিনিধি রয়েছেন, তাদেরসহ সরকারি-বেসরকারি সবাইকে নিয়ে একটি সমন্বিত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা কৃষিকে ঘিরে করা দরকার। অর্থনৈতিক রূপান্তরে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা না দেয়া হলে শিল্প গড়ে উঠবে না এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার গ্রুপ
[বণিক বার্তা আয়োজিত কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলনের ‘খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা’ বিষয়ক অধিবেশনে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে]