৫ মে ২০২৫ রাজধানীর সচিবালয়ে ঘটে গেলো এক ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক প্রতিবাদের দৃশ্য। সচিবালয়ের সামনে সহস্রাধিক ছাত্রজনতা দুপুরের পর জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে স্লোগান দিতে থাকে বিশেষ কিছু দাবিতে ।
জুলাই-অভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এসব প্রতিবাদরত সাধারণ ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি হিসেবে তারেক রেজা (যুগ্ম সদস্য-সচিব, এনসিপি), রফিকুল ইসলাম আইনী (কেন্দ্রীয় সংগঠক, এনসিপি),সজীব মিয়া (সাবেক ছাত্র সংগঠক ও গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী) এর নেতৃত্বে একটি দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর এক স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ‘ফ্যাসিস্ট দোসরদের পুনরুৎপত্তি’, জুলাই-আগস্ট যোদ্ধাদের ওপর ধারাবাহিক হামলা এবং প্রশাসনের পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে তাৎক্ষণিক শুদ্ধি অভিযানের দাবি জানানো হয়।
স্মারকলিপি প্রদান শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে প্রতিনিধি দলের একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দাবিসমূহ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হলে সাধারণ ছাত্ররা সচিবালয় এলাকা ত্যাগ করে প্রেসক্লাবের সামনে যেয়ে অবস্থান নেয়। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না এলে তারা ছাত্র-জনতা ঐক্য গড়ে তুলে দেশজুড়ে বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবেন।
স্মারকলিপির মূল দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. হাসনাত আবদুল্লাহর উপর হামলার ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত গঠন করতে হবে। জুলাই যোদ্ধা তথা প্রত্যেকটি সাধারন নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
২. রাতের ভোটের নির্বাচনী প্রহসনে জড়িত সকল আমলাকে (সচিব থেকে ইউএনও পর্যন্ত) অপসরন ও বরখাস্ত করতে হবে।
৩. প্রশাসনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিস্ট দোসরদের চিহ্নিত করে সচিবালয়, সরকারি দপ্তর ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে নির্মূল করতে হবে।
৪. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চেতনাভিত্তিক ওবং জুলাই- আগস্টের স্পিরিট ধারনকারী একটি প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে।
৫.ফ্যাসিস্ট ও দুঃশাসনের প্রতীক যেসব ফ্যাসিস্টের দোসর অপরাধী জামিনে মুক্তি পাচ্ছে—তাদের জামিন পুনর্বিবেচনা করে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
স্মারকলিপি প্রদান শেষে প্রতিনিধি দলের সদস্য সজীব মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, “এই রাষ্ট্র হাজারো ছাত্র-জনতার রক্ত দিয়ে অর্জিত। আজও সেই ছাত্র সমাজ তাদের অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা রক্ষায় প্রস্তুত। এই প্রশাসনিক সন্ত্রাস, এই নীরব প্রতিক্রিয়াশীলতা আর সহ্য করা হবে না। রাতের ভোট ও ডামি ভোটের কুশীলব আমলারা পরিকল্পিত ভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরী করে দেশকে স্থবির করার সাথে জড়িত । তাদের চক্রান্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব সহ অন্যান্য যে সব প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা রয়েছে তারা ঠিভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এসব জটিলতা সৃষ্টিকারী আমলাকে অনতিবিলম্বে সচিবালয়সহ সকল সরকারি দপ্তর থেকে অপসারণ করে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে । ”
তাছাড়া প্রতিনিধি দলের সদস্য রফিকুল ইসলাম আইনী (কেন্দ্রীয় সংগঠক,এনসিপি) জানান যে “হাসনাত আব্দুল্লাহ এর উপর হামলার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মন্তব্য করেন তিনি নাকি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে এভাবে নির্লিপ্তত ও গা ছাড়া মন্তব্য একজন ব্যক্তি কিভাবে করতে পারেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। কাল আমি রফিকুল ইসলাম আইনী যদি হামলায় নিহত হই আপনি মন্ত্রীপরিষদ সচিব ঠিক ই সচিবালয়ে এসি রুমে বসে অফিস করবেন। আপনাদের এই নির্লিপ্ততার জন্য এত হাজার ছাত্র জনতা প্রাণ দেয় নি ও আহত হয় নি।ইন্টেরিম যদি দাবি সমূহ বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করে বা এর কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটে তবে মুক্তিকামী সাধারণ ছাত্র-জনতা জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে সমুন্নত রাখতে ও উত্থাপিত দাবি সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোন ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিস্টের দোসর সুবিধাভোগী আমলা কাউকে রেহাই দেবে না।”
সর্বশেষ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য তারেক রেজা (যুগ্ম সদস্য-সচিব, এনসিপি) সংবাদ মাধ্যমকে জানান যে, “ স্মারকলিপিতে বর্ণিত দাবি সমূহ সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত । ফ্যাসিস্ট হাসিনা যে অসম ক্ষমতাধর হিসেবে আমলাতান্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছিল তা অভ্যুত্থানের ৯ মাস পর ও কোনরূপ পরিবর্তন হয় নি। জনপ্রশাসনে এখনো ফ্যাসিস্টের দোসরেরা পরিকল্পিত ভাবে এই সরকারকে ব্যর্থ করতে চক্রান্ত করে যাচ্ছে। অনতিবিলম্বে এসকল দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তে সরকারের উপনীত হতে হবে। তা না হলে ছাত্র-জনতা তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে আবারো ফ্যাসিবাদের দোসরদের উৎখাতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে”।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই স্মারকলিপি কেবল একটি অভিযোগপত্রই নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের ভেতরে গড়ে ওঠা আধা-ফ্যাসিস্টিক গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে এক কৌশলগত প্রতিবাদ। প্রশাসনের নীরবতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-জনতার এমন অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে বলেই মনে করছেন তাঁরা। তাছাড়া বিএনপি বা এনসিপির মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা পরস্পর প্রতি অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদল আনুষ্ঠানিকভাবে হাসনাত আব্দুল্লাহর উপর হামলার যে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ জানিয়েছে তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে ও দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
স্মারকলিপিতে দেয়া আলটিমেটাম এবং জনগণের ক্ষোভ প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে কাঁপন ধরিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন সত্যিই শুদ্ধির পথে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়, নাকি এই নীরব বিস্ফোরণের আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।