বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে গোপনে বেড়ে ওঠা দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর দায়ের করা একটি অভিযোগপত্রে বাহিনীর পাঁচজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার, যৌন হয়রানি এবং বেআইনি সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে।
এই অভিযোগে নাম এসেছে পাঁচজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার:
১. মোঃ ফখরুল আলম – উপমহাপরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত)
২. সৈয়দ ইফতেহার আলী – অতিরিক্ত পরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত)
৩. মুহাম্মদ মেহেদী হাসান – পরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত)
৪. এ কে এম মিজানুর রহমান – সাবেক এডিজি (অবসরপ্রাপ্ত)
৫. মোঃ ফিরোজ খান – সাবেক এডিজি (অবসরপ্রাপ্ত)
⸻
ফখরুল আলম: দুর্নীতির ‘পোস্টারবয়’
২১তম বিসিএস ক্যাডার মোঃ ফখরুল আলম ২০০৩ সালে আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, সিলেট ও কুমিল্লা জেলার কমান্ড্যান্ট থাকাকালে তিনি আনসার সদস্যদের বদলি, অঙ্গীভূতকরণ ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রমে ঘুষের বাণিজ্য চালিয়েছেন।
২০১০ সালে একটি মোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ প্রকল্পে বরাদ্দ ২৫,০০০ টাকার মধ্যে মাত্র ৭,০০০ টাকা খরচ দেখিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করেন। প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম ক্রয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে আনসার ও ভিডিপি একাডেমির কেন্দ্রীয় মেসে নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং মহিলা ব্যাটালিয়নের সদস্যদের যৌন হয়রানি। অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে, তিনি ঢাকার অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক, যা তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
⸻
সৈয়দ ইফতেহার আলী: রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতির বিস্তার
২৮তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা ২০১০ সালে বাহিনীতে যোগ দেন। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি আনসার ও ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পিএস থাকাকালে বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিতেন।
২০২৩ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি তদন্তে তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। ২০১৮ সালে বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে বেআইনি লেনদেনের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
তাকে ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে অনুষ্ঠিত আন্দোলনে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে, যেখানে তিনি আনসার সদস্যদের উসকানি দেন।
⸻
মুহাম্মদ মেহেদী হাসান: প্রশিক্ষণ ফান্ড লুট ও সরকারি অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলার নজির
২৫তম বিসিএস কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ২০০৬ সালে বাহিনীতে যোগ দেন। অভিযোগ অনুযায়ী, গোপালগঞ্জে জেলা কমান্ড্যান্ট থাকাকালে তিনি ৬১,৫০০ টাকার সরকারি বরাদ্দ ভুয়া ভাউচার তৈরি করে আত্মসাৎ করেন।
নেত্রকোনায় কর্মকালীন সময়ে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ না নেওয়ার মতো দায়িত্বহীনতার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে। ২০২৪ সালে সচিবালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত জাতীয়করণ আন্দোলনে তিনি আনসার সদস্যদের উৎসাহিত করেন। তার নামে ঢাকার মধু সড়কে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটসহ একাধিক সম্পত্তির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
⸻
এ কে এম মিজানুর রহমান: বরিশাল সিন্ডিকেট ও অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে আলোচিত
১৯৮৬ সালে বাহিনীতে যোগ দিয়ে ২০১৯ সালে এডিজি পদ থেকে অবসর নেওয়া এই কর্মকর্তা অভিযোগ অনুযায়ী, তার কর্মজীবনজুড়েই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। জনতার মঞ্চে অংশগ্রহণ, সেনাবিদ্বেষী মনোভাব, বিভাগী বিভেদ সৃষ্টির প্রমাণ তার এপিআর রিপোর্টে উল্লেখ ছিল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, তিনি অসংখ্য মহিলা আনসার সদস্যের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং বারিশাল কেন্দ্র করে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
⸻
মোঃ ফিরোজ খান: সিনিয়র অথচ শৃঙ্খলাভ্রষ্ট
৮ম বিসিএস ক্যাডার মোঃ ফিরোজ খান ১৯৮৯ সালে বাহিনীতে যোগ দেন এবং ২০২০ সালে অবসর নেন। অভিযোগ রয়েছে, জামালপুরে অ্যাডজুটান্ট হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তিনি সরকারি মালামাল আত্মসাৎ করেন এবং নানা আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিলেন।
১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে বক্তব্য দেয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। বেনামী দরখাস্তের মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলার নিন্দনীয় অভ্যাসও তার ছিল। ঢাকার বাড্ডা ও মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে নিয়মিত মদ্যপান ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগও এসেছে।
ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর অভিযুক্ত ৩ জন কর্মকর্তা মো: ফখরুল আলম , সৈয়দ ইফতেহার আলী, মুহাম্মদ মেহেদী হাসান কে সাময়িক বরখাস্ত করেছে আনসার ভিডিপি কর্তৃপক্ষ।
⸻
এই ভয়াবহ অভিযোগগুলো ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে দাখিল হয়েছে। দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে তা যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে এবং প্রাথমিক তদন্তে বেশ কিছু তথ্য সঠিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে কমিশন।
⸻
দুদকে অভিযোগের ব্যাপারে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ এর কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি জানান, “আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি পেশাদার, শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং জাতির নিরাপত্তা ও সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি বাহিনীর কয়েকজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঘুষ এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত অভিযোগ আমাদের দুঃখিত এবং বিস্মিত করেছে।
এই অভিযোগসমূহ যদি সত্য হয়, তবে তা বাহিনীর শুদ্ধ মানসিকতা ও গৌরবময় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ—বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)—এর বিষয়ে যদি আমাদের কোন সহযোগিতা চায় আমরা সম্পূর্ণ এই কার্যক্রমকে সহযোগিতা করবো।”
তিনি আরো জানান, “বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে চলছে এবং ভবিষ্যতেও যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখবে। আমরা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”